প্রথম কাপ *****
পিরামিডের শেষ ব্লকটা লাগাতে লাগাতে মো ফিরে তাকালো উস এর দিকে। বালক রাজার কফিনের ভেতর কফির মগ দিতে ভুলিসনি তো! উস বেশি কথা বলে না। পুরোহিতদের বলতে নেই । মাথা ঝুঁকিয়ে একটু হাসলো। তুতানখামেন পরজন্মে পিরামিডে রয়ে গেলেন অপেক্ষায়।
না না। এমনটা হয়নি আশা করি। সেরামিকের মগ হয়তো ছিলো। অন্য কোনো পানীয়ের আশ্রয়। ষোড়শ শতকে মিশরে কফির অনুপ্রবেশ আজানের মাঝে গলা ভেজানোর জন্যে।
আমরা ইতিহাস দেখি। শুনি। যা এবং যেটুকু দেখানো হয়। শোনানো হয়। ইতিহাস বলে কফির প্রথম চুমুক ইথিওপিয়ায়। কাফা নামের এক জায়গায় বাস করতো কালদি নামের এক মেষপালক। তার ছাগলগুলো প্রায়ই লাল বেরিঝোপের আশেপাশে ভিড় জমাতো। একদিন কালদী ওই ফল গুটিকয় খেলো। তারপর আবার। আবার। মনে প্রাণে বেশ ফুর্তি। বাড়ি নিয়ে এলো। জলে ফুটিয়ে সবাই মিলে খেলো গ্রামসুদ্ধু। কাফা থেকে কফি।
কয়েক শতাব্দী লেগে গেল ইথিওপিয়া থেকে ইয়েমেন। লোহিত সাগরের এপারে কফি চাষ শুরু। তারপর আর কি। এলাম দেখলাম জয় করলাম।
আমাদের ছোটবেলায় বাড়িতে কফি আসতো শীতকালে। একতলার রান্নাঘরে। কনকনে সন্ধ্যা। মা কফি বানাচ্ছে আর সেই মৌতাতে চিলেকোঠার ঘর থেকে পড়া ছেড়ে পায়ে পায়ে নেমে আসা। প্রথম চুমুক ক্লাস এইটে। অনেক চিনি। অনেক দুধ। অল্প কফি। ধোঁয়ামাখা হালকা মিষ্টি কড়া চকলেটের কাছাকাছি। তবু অন্য। বড় হওয়ার গন্ধ।
কলেজে। ফার্স্ট ইয়ার। দুই বন্ধু। অনেক শোনা অনেক পড়া কফি হাউসের সিঁড়িতে। বুক ঢিপঢিপ। কফি আর সিগারেটের গন্ধ ম ম হলঘর। আনাচে কানাচে চুঁইয়ে পড়া সংস্কৃতি। মফঃস্বল হাওড়ার তরুণ চোখে স্বপ্নের কলকাতা।
আড্ডাটা আজ আর নেই। চরিত্র পাল্টাচ্ছে। বহতা নদী আর সময়। পাড় ভাঙ্গে। চর জাগে। নতুন বসতি। কাপে কফি দে। কফি ওয়ার্ল্ড। দুই দুই, চার চার টেবিল। কোথাও কোথাও দাঁড়িয়ে। জগা দুটো চাফি। চায়ের কাপে এক চিমটে। জীবনে কি পাবোনা। বিবর্তনের হাত ঘুরে কফি ৩৬৫ ।।
দ্বিতীয় কাপ *****
শুচিস্মিতা হাসতে হাসতে সোফা থেকে গড়িয়ে পড়ার অবস্থায়। আমার অবস্থাও তথৈবচ। অনিন্দ্য গুলবাজ নামকরা। তা বলে এতটা! বলে কিনা এক কাপ কফি সাড়ে তিন থেকে দশ হাজার!! ওকে কোণঠাসা করার এই সুযোগ কি ছাড়া যায়! ডাকো গুগুলবাবাজিকে। এবার আমরা! বেকুব। বিস্ময়ে হতবাক। ইন্দোনেশিয়ার সিভেট কফি এক কাপ 35 থেকে 100 ডলার। কফি তৈরির পদ্ধতি অনুযায়ী নাম। ওখানকার ভাম (সিভেট) পাকা এবং পরিপুষ্ট কফি ফলগুলো খেয়ে ফেলে। তারপর ভামের পাচনতন্ত্রের হজমি অনুঘটকের জাদু। ওদের পটি থেকে কফিবীজ সংগ্রহ করে শুকনো করা হয়। অ্যাসিডের মাত্রা কম। তেতো স্বাদ কম। পাওয়া যায় কম। তাই এতো দাম। শুচিস্মিতা (স্বঘোষিত কফি স্পেশালিস্ট) ঘোষণা করলো খাবো না কক্ষনও। আমি চুপ। খাওয়ার জন্যে বাঁচা। নাকি উল্টোটা! গুলিয়ে যায়।
ফুটবল আর কফি। ব্রাজিল ব্রাজিল ব্রাজিল। সারা পৃথিবীর চল্লিশ শতাংশের জোগান। তবে সবচয়ে উপাদেয় জ্যামাইকান ব্লু কফি। নশো থেকে পনেরশ মিটার পাহাড়ের চাষ। কফিখোর জাত কিন্তু ফিন। মানে ফিনল্যান্ডের লোকজন। প্রায় চার কাপ দিনে একেকজন। আমাদের চাতালদের মত আর কি।
ইথিওপিয়া কফির মাতৃভূমি। অবশ্যই বিখ্যাত। বেশ কড়া। বেশি খেলে পেট ব্যাথা।গলা বুক জ্বালা। কফি আরাবিকা গাছ থেকে তৈরি তাই অনেকে একে আরাবিকা বলে।বাকি আফ্রিকান কফি রোবাস্টা। তেতো ভাব বেশি। গাছের নাম কফি আফ্রিসিয়নাদো। মেক্সিকোয় কফি চাষ প্রচুর। তবে কেতাদুরস্ত কফি মানেই ইতালি।
ইউরোপে কফি ইতালির হাত ধরে। সপ্তদশ শতাব্দীতে।1720 সালের ভেনিসের ক্যাফে আজও চলছে।ইতালি। জলপাই। ভেনিস। গন্ডোলা। শ্বেত পাথরের গোল টেবিল। লাতে, এসপ্রেসো, ক্যাপুচ্চিনো। সোফিয়া লরেন, মণিকা বেলুচ্চি, রবার্ট ডে নিরো। স্টাইল, এটিকেট, সোবার। উচ্চতার প্রতিভূ। কফি এখানে ক্যাফে। কফি আদবকায়দার নাম ইল গেলাতিও ডেল ক্যাফে। সকালে একরকম, দুপুরে এক। রাতে আরেক। কফি আলাদা আলাদা। কফি সংস্কৃতি। কফি খাওয়ার আসল জায়গা বার। হ্যাঁ। মদ্যপান ও কফিপানের পীঠস্থান একই। কফি কারিগর ব্যারিস্টা। মাননীয় পদ। সবথেকে বেশী চলে এসপ্রেসো। এক চুমুকে শেষ। অল্প। বার বার। কফির বিভিন্নতার খবর দেবো পরে। অন্য কোনো পর্বে। তোতা কাহিনীর মতোই কফি কাহিনির অনেক শিক্ষক। অনেক আদব ও আদাব। কেতা ও কায়দা। নীলগিরি কফিতে একটু চুমুক এবার।
বাবা বুদান। পীরসাহেব। ষোড়শ শতকে হজে গেলেন। ফেরার সময় ইয়েমেনের সরাইতে কফির পেয়ালায় চুমুক আর ফিদা। কর্ণাটকের পীরবাবা তার মুলুকে কফি আনতে হিমশিম। ইয়েমেনিরা বেচতে চায় রোস্টেড কফি বিন। জপমালায় লুকিয়ে মোটে সাতটি গ্রীন কফি বিন বাবা বুদান নিয়ে এলেন। ভারতে। কর্নাটকে। সে পাহাড়ের নাম বাবা বুদান। কফি চাষ হয় সেখানে আজও। নীলগিরি কফি কিন্তু স্বাদে গন্ধে আরবিক।
ছোটবেলায় কন্যাকুমারী। সামনে বিবেকানন্দ রক। স্টিলের বাটি আর গ্লাসে কফিতে চুমুক। ভুলতে কি পারি? কফি মেকার আর রোস্টেড কফি ডাস্ট। অরুণ শিলের ওয়াটারলু স্ট্রিট চেম্বারের পিছনে মিনি কিচেন। আমার কফি প্রেম। পরতে পরতে।
কফির কাপ। হালকা মিষ্টি পোড়া গন্ধ। চুপ তাকিয়ে চোখের তারায়। চাঁদ উঠেছে, চাঁদ উঠছে। শহীদ মিনার লাইটহাউস। এমন সন্ধে আর ভুলে যাওয়া প্রেম। হাজার লক্ষ বার। মরে যাওয়া। শেষ চুমুক একা। ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। ভাই … ব্ল্যাক কফি। চিনি ছাড়া।।
তৃতীয় কাপ *****
ইতালির কফি কালচার বিশ্বখ্যাত। কিন্তু তুর্কী জীবনে কফি প্রেম রোমিও জুলিয়েটের মত। অটোমান সাম্রাজ্যের হাত ধরে তুরস্কে কফি। ব্লু মস্কের সামনে এক ক্যাফে আর গোধূলির আলোমাখা ঝরা ফুলে ঢাকা কালো পাথরের রাস্তা। স্মৃতি। সুখস্মৃতি। টারকিশ তোয়ালে আর টার্কিশ রুটির মতোই কফি। ছেলের বাড়ি থেকে বিয়ের পাকা কথা বলতে যখন মেয়ের বাড়ি আসে, ভাবী বধূ নিজে হাতে কফি বানিয়ে দেয় পাত্রপক্ষের সবাইকে। কখনো পাত্রের কাপে চিনির বদলে দেয় নুন। অম্লানবদনে মৃদু চুমুক। আহ্। পাত্র বোঝায় তার সহিষ্ণুতা। অনেক নুন। মেয়েটি চায় না এই সম্পর্ক। কফির মতোই বিয়েতেও চাই মনের ঠিকঠাক মিশে যাওয়া।
দক্ষিণ ভারত কফি সংস্কৃতি 1700 খ্রিষ্টাব্দ থেকে আবহমান। মাইশোর কফি ইতালিতে আজও চলছে। সারা পৃথিবীর মানুষ ইনস্ট্যান্ট কফি খেলেও তামিল তেলেগু কন্নড় আজও ফিল্টার কাপি। তাকে বুঁদ বিসনেরু, কুলাম্বি বা ডিগ্রী কফি যে নমেই ডাকা হোক। রোস্টেড কফি বিন গুঁড়ো করে ফিল্টারের মধ্যে দিয়ে গরম জলে মিশে যায় ভালোবেসে। চুঁইয়ে পড়া সেই আশ্চর্য্য কোনও উচ্চমানের হুইস্কি বা ওয়াইনের সমতুল। এরপর অপরূপ ভঙ্গিমায় দুধ চিনির সাহচর্যে দাবারা আর গ্লাসে উঁচু থেকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ঢালা হয় সেই মিশ্রণ। ফেনা ওঠা কাপির সুগন্ধে ভরে যায় আশপাশ। উঁচু থেকে ঢালা হয় তাই কেউ কেউ বলে মিটার কফি।মাদ্রাস কফি হাউসের শাখায় লন্ডনেও ভিড় হতো সেই জমানায়।
বিলেত ফেরত শঙ্কু এক সকালে এক কাপ কালো কফিতে একটা লেবুর রস। ছোট ছোট চুমুক। মাথা ধরেছে। ত্বকের লাবণ্য। অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট। আরো কত কী। অরুণদা বলতেন কফিতে হৃদয় ভালো থাকে। শিরা উপশিরায় জমা চর্বি কমে। শর্করার মাত্রা কমায়। লিভার, প্রস্টেট, অগ্ন্যাশয়ের ক্যান্সার আটকায়। মন খারাপ কমায়। অনেক নামী দামী চামড়ার লোশনের উপাদান কফি বা রেড বেরী। এতো ভালো লাগে। প্রতি চুমুকে এনার্জি। সব ওই ক্যাফিনের কেরামতি। বেশি খেলে অপকার। তাই ডিক্যাফ। ক্যাফিনের মাত্রা কমাও। জলে ফুটিয়ে। অ্যাসিডের ছোঁয়ায়। শতেক উপায়।
টঙের ঘর। শিবুর বাড়িয়ে দেওয়া কৌটোর থেকে বড় ক্ষমাঘেন্না করে সিগারেটের ধোঁয়া। কপি তারেক এর কাছে তোদের এসব ফিল্টার আর ইনস্ট্যান্ট পানসে। মালয়েশিয়ায় সু ট্যান খাইয়েছিল। গোঁফ থেকে সেই কফির গন্ধ যাচ্ছিল না কিছুতেই। তাই তো আমি গোঁফটাই দিলাম ঘচাং ফু। ঘরে কি একটা পিন পড়লো?
কফি মানেই ঘন দুধ বা ক্রিম, গুড় বা চিনি। আর ব্যাঙ্গালোর কিংবা মাইসোর বা চেন্নাইতে চিকোরি। এটা একান্তই ভারতীয়। উজ্জ্বল নীল ফুলের এই গাছের মূল (কোথাও ডাল পালা) রোস্ট করে মিশিয়ে দেওয়া হয় ফিল্টার কফিতে। কখনো 15%থেকে 80% পর্য্যন্ত। স্বাদ গন্ধ বেড়ে যায় অনেকটুকু। কোথাও ব্র্যান্ডি, কোথাও হুইস্কি। কেউ লেবু কেউ বা চিকোরী। কফি সংস্কৃতি বহতা নদীর মতোই দেশ কাল মানুষে একাকার।
কলেজ স্ট্রীট ইন্ডিয়ান কফি হাউসের ফলকে এখনও পড়া যায় — ‘স্থাপিত ১৭২০’। কফির কাপে তুফান তোলার দিনরাত বাড়িটার কড়িবর্গায়, বিরাট জানলার খড়খড়ি আর পেয়ালা পিরিচে আজও ফিসফাস। যাবেন? আরেকবার?
চতুর্থ কাপ *****
আলী। 6’3″ । গমরঙা। ঝকঝকে চোখ মুখ। পাতলা কালো চুল। হোটেলের রিসেপশন থেকে সটান আমার পাশে। ফিসফিস করে বলল…ডেনিজ আপনার জন্যে অপেক্ষায়। বাইরের লবিতে। আমিতো বুরবক। তুর্কী ভাষাও জানি না। আবার গাইডদের মধ্যে ডেনিজ দুজন। একজন মহিলা অন্যজন বৃষস্কন্ধ শ্মস্রুশোভিত বিনয়ের অবতার।
ইনি কিনি! দেখা যাক। হিজাব পরিহিতা দেনিজ। ইস্তাম্বুলের কালো পাথরের রাস্তা দিয়ে এমন এক মারকাটারি সুন্দরীর সঙ্গে হেঁটে যাওয়াটাই একটা রেড লেটার ডে।
খানিকক্ষণ এলোমেলো কথা আর চলা। ফুলের কেয়ারি করা একটা বাড়ির দরজায় দড়ির ঘণ্টায় ডিং ডং। সুদর্শন বয়স্ক দম্পতির আপ্যায়ন। এটা ডেনিজের বাড়ি। অতিথি মানেই কফির নিমন্ত্রণ। বসার ঘরের লাগোয়া ওপেন কিচেন। তামা আর পিতলের কফি তৈরির পাত্র চেভ (cezve) । চিনি কতটা? মিহি কফির গুঁড়ো বড় এক চামচ, এক কাপ জল , এক চামচ মিহি চিনি….. আমার জন্য। তিন চার মিনিট ফোটানো। চামচ করে উথলে ওঠা ফেনা কাপে সযত্নে। আবার ফোটানো। আধা কাপ কফি। আবার আগুন। এবার কানায় কানায় পূর্ণ। আগে একটু টার্কিশ ডেলাইট। ঠাণ্ডা জল। কফিতে চুমুক। দুধ/ক্রিম নৈব নৈব চ। টার্কিশ কফি সংস্কৃতি। খাওয়া শেষ। ওমা……কাপের তলানিটা প্লেটে উপুড় করে দিলেন বৃদ্ধা। কফির অবশিষ্ট গুঁড়োর সজ্জা দেখছেন মন দিয়ে। টাসিওগ্রাফি। আমি জানি। বৃদ্ধার হাসিমুখ। সব ভালো। উপকারী। দীর্ঘ জীবন। সুন্দরী স্ত্রী। সুস্থ সন্তান। মানি বা না মানি। বিশ্বাসে মিলায়।
আরাবিকা আর রোবাস্টা। রোবাস্টার দানা একটু বেঁটে মোটা। তাই বোধ হয় এমন নাম। তেতো স্বাদ বেশী। দাম কিছু কম। কফি বীজের রকম প্রধানত এই দুই। আফ্রিকায় কমিউনিজমের দীক্ষা একসময় কফিবীজের নির্যাসের কালচে তৈলাক্ত রস মুখে মাখিয়ে। যস্মিন দেশে যদাচার।
গড ব্রিউজ দ্য কফি। ম্যান জাস্ট হ্যান্ডস অন ইট। নাইন- টেনে পড়া ‘ কাপ অফ কফি ‘ । কাপ তুমি যেমনই নাও, ভেতরের কফি একই। এখনো মনে আছে। তোসিকাজু কামাগুচির ‘ বিফোর দ্য কফি গেটস কোল্ড ‘ টোকিওর এক ক্যাফে আর ফিরে দেখার, পারিবারিক মূল্যবোধের গল্প। টডি ফেরেট আর তার ইথিওপিয়ায় কফি সাম্রাজ্যের গল্প সলমনের ‘ কফি স্টোরি ‘ । তবে কফির ছোঁয়ায় আমার সবচেয়ে প্রিয় বেঞ্জামিন অবলেরের ‘টপ টেন ফিকসিয়াস কফি সিনস’। রোমান্টিক বোরডম এর মতো চমকে দেওয়া শব্দ আছে। আর আছে ‘একটা বন্ধুত্ব চাই, একটা সঙ্গী, একটা কফি’।
আমার এক বন্ধু রুদ মন খারাপ করে বলেছিল— যত ইচ্ছে করুক না কেন, আমি কখনই কফি পান করতে পারবো না। আমি মরমন সম্প্রদায়ের খ্রিস্টান। আমরা ওয়ার্ড অফ উইজডম মেনে চলি। কফি উত্তেজনা। চা, মদ ও তাই। আমাদের বারণ। আমি পোপ এর প্রসঙ্গ তুললাম। কিন্তু ওই যে। ঈশ্বর কার কানে কি বলেছেন- ভগা জানে। তবে হ্যাঁ। কিছু স্ক্যান্ডিনেভিয়ান সংস্কৃতির মতো কাঁচা ডিম ভেঙে কফিতে মিশিয়ে…আরে ছি ছি। আমি ও পথে নেই ভাই।।
পঞ্চম কাপ *****
কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই………মান্না দের অমর কাহিনী। সবথেকে বেশি প্যারোডি, কলেজের ক্যান্টিনে সবথেকে বেশিবার গাওয়া গান। প্রত্যেক জেনারেশন তার নস্টালজিয়া খুঁজে পায়। চারমিনারের সঙ্গে কফি আর কাটলেট ফিস ফ্রাই এর ধোঁয়া গন্ধ মিলে মিশে কড়াপাকের ঐতিহ্য। বিষ্ণু দে তাঁর এলিয়ট প্রীতি বোঝাচ্ছেন কোথাও। কোথাও কমলকুমার মজুমদারকে ঘিরে তৈরি হচ্ছে একটা মিথ। আবার শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের উৎসাহে সৌমিত্র সম্পাদনা করছেন এক্ষণ। সত্যজিৎ, সুনীল, শক্তি, কফি হাউস, বইপাড়া। বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতির আঁতুড়ঘর।
আসলে অষ্টাদশ শতকে কলকাতার ইংরেজ সমাজ আড্ডার একটা জায়গা খুঁজছিলো। লাটসাহেবের অনুমতি পেতেই উইলিয়াম সাহেব বাগানবাড়ী কিনে ফেললেন। লন্ডন হোটেল। একটা বড় ঘর কফি রুম। এক কাপ এক সিক্কা। চললো না। বইপাড়ায় কফি হাউস। বাদামী চোখের কাকলি। এতো কথা। আমি ভাবছি অ্যারাবিকা, রোবাস্টা, লিবেরিকা, এক্সেলসা। আমরা ভারতে (দক্ষিণ বাদে) খাই ইনস্ট্যান্ট কফি। অধিকাংশ নেসক্যাফে। নেসক্যাফে ক্লাসিক মানে রোবাস্টা। ব্রু ভারতীয়। ব্রু ক্লাসিক চিকোরি আর অ্যারাবিকার মিশেল। ডাভিদর্ফ বা স্টারবাকস অল্পবিস্তর।
লম্বা পোর্শিলেনের কফি কাপ। এক চামচ কফি। চিনি প্রয়োজনে। এক চামচ জল। চামচের নাড়াচাড়া মৃদু থেকে দ্রুত। অতিদ্রুত। কফির গন্ধে ম ম। ফেনিল গাঢ় বাদামী তরল। নির্যাসের তেল টলটল। এরপর উঁচু থেকে ফুটন্ত জল। মিটার কফি। কখনও গরম দুধ। কালো কফি চল্লিশ শতাংশ মানুষের প্রিয়। দিনে দু চারকাপ খেলে ক্ষতি নেই। অধিকন্তু দোষায়।
বিশ ত্রিশ রকমের কফি। পিতৃপুরুষ কিন্তু এসপ্রেসো। কফি – গরম জল আর ফেনা। চিনি দিয়ে বা না দিয়ে। এক চুমুকে শেষ। গরম জল মেশালে আমেরিকানো। কেউ বলে ক্যাফে নয়ার। ডবল এসপ্রেসো ডপিও। এসপ্রেসোর সঙ্গে কিছুটা ফেনা আর ফুটন্ত দুধ লাত্তে। বেশি ফেনা হলেই ক্যাপুচ্ছিনো। এসপ্রেসো আর দুধের জম্পেশ যুগলবন্দী কর্তাদো। রাতজাগা উড়ানের পর এয়ারপোর্ট কফি লাউঞ্জে পাইলট অর্ডার দেন রেড আই। এক কাপ গরম কফিতে একটা এসপ্রেসো শট। মোচা কফি হলো এসপ্রেসো আর চকলেট আর ফেনা আর গরম দুধের জলসা। মাচিতো, গালাও (পর্তুগিজ), রিস্ট্রেটো, ফ্ল্যাট হোয়াইট এদের রকমফের।
দুটো বা একটা এসপ্রেসো শট আর এক স্কুপ ভ্যানিলা আইসক্রিম— আফোগাটো। তবে সবথেকে বেকুব হয়েছি ডাবলিনে। মিশেল নিলো কাপুচ্ছিনো আর আমি চাইলাম আইরিশ কফি। ও হরি। সেতো ককটেল। এসপ্রেসো, চিনি, ফেটানো ক্রিম আর হুইস্কির মেলবন্ধন। তবে হ্যাঁ। খেতে কিন্তু তুর্কী। দুটো খাওয়ার পর মিশেল টেনেটুনে ক্যাফে থেকে বার করে না আনলে কী যে হতো!
কোল্ড কফি বা আইসড কফিরও মোদ্দা কথা ওই এসপ্রেসো। হোমিপ্যাথিক মাদার টিংকচারের মতো। স্টারবাকস এর ফ্রাপুচ্ছিনো তো অনেকের প্রিয়। কোল্ড ব্রিউ, মাজাগ্রান বা নাইট্রোজেন বুদবুদ ওঠা নাইট্রো অনেকের পছন্দ। কোথাও সিরাপ কোথাও আইসক্রিম, কোথাও ফেটানো ক্রিমের মিশেল।
নীলগিরি পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসছে ছোট্ট একটা নদী। পায়ে পায়ে আব্রামের গ্রাম। দাওয়ায় কফি বীজ বিনবিনে বৃষ্টিতে ভিজছে। নষ্ট হয়ে যাবে তো!! কি জানো তুমি! কতটা! পুঁথির বাইরে শেখো। আমাদের চাষ। আমাদের ধরন। আব্রামের বুড়ো ঠাকুরদা কফির মগ নিয়ে আকাশের নিচে। দু হাত উঁচু। সুরেলা অদ্ভুত মন্ত্রচ্চারণ। ভিজে হাওয়ায়, মেঘের পিঠে সওয়ার সেই সুর। ইয়েমেন, ইথিওপিয়া, মেক্সিকো, ইতালি, তুরস্ক। কফি কারিগর উপরওয়ালা। আমাদের তো দুই হাতের চিক গোল্লা।।
আর বলার কিছু ছিলো না।।